উনত্রিশ ফেব্রুয়ারি -- ৬

 সাজু তখনও মোবাইলের স্ক্রিনে তাকিয়ে আছে। রাবেয়া চারিদিকে একবার তাকিয়ে নিল। এরকম সময় সচারাচর রেস্টুরেন্টে মানুষ কম থাকে। বিকেল থেকে মানুষের পরিমাণ বাড়তে থাকে।

- তারমানে আপনি বলতে চাচ্ছেন খুনের সঙ্গে আপনার বয়ফ্রেন্ড সাকিব জড়িত আছে?
মোবাইল সাইডে রেখে রাবেয়াকে প্রশ্ন করলো সাজু ভাই।
- যেহেতু সে আগেই এরকম পরিকল্পনা করেছে তাই সেটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। আপনি চাইলে তাকে কেন্দ্র করে তদন্ত করতে পারেন। জানিনা কতটা সফল হবেন। তাছাড়া...
- তাছাড়া কি?
- সাকিব রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে জড়িত। আপনার জন্য ওর নাগাল পাওয়া কষ্টকর হবে।
- এরকম একটা মানুষ আপনার বয়ফ্রেন্ড ছিল?
- সম্পর্ক আসলে কেমন সেটা বোঝাতে পারবো না। আমার মনে হয় নুড়ি ভাবি আমাদের বাসায় ভাড়া থাকে এটা জানার পরে সে ইচ্ছে করে আমার পিছনে লেগেছিল।
- কতদিনের রিলেশনশিপ ছিল আপনাদের?
- সাড়ে তিন মাসের মতো। তারপর তো সে নিজের কথা বলে। আমি সরাসরি তাকে নিষেধ করি।
- আপনি এ কথা কাউকে বলেন নাই? সাইমুন বা তার স্ত্রী এদের জানান নাই যে তাকে খুন করার জন্য কেউ সুযোগ খুঁজে বেড়াচ্ছে।
- নাহ, আগেই বলেছি সাকিব রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সংযুক্ত আছে। আমার সবচেয়ে বড় দুর্বলতা আমার ছোটবোন৷ সাকিব বলছিল যে আমি যদি এসব কাউকে বলি তাহলে আমার বোনের ক্ষতি হবে।
- কিন্তু এখন যে বলে দিলেন? ভয় হচ্ছে না?
- নিজের মধ্যে অপরাধবোধ কাজ করছে। শুধু মনে হচ্ছে আমি যদি আগে তাদের বলতাম তাহলে তারা সতর্ক হতে পারতো।
- সাকিবের সঙ্গে কিসের শত্রুতা সেরকম কিছু জানেন? কিছু কি বলেছে আপনাকে?
- না বলেনি। আমি জানার জন্য অনেক চেষ্টা করছি কিন্তু জানতে পারিনি। আশা করি আপনি তদন্ত করলে সবকিছু জানতে পারবেন।
- ঠিক আছে , এতটুকু তথ্য জানানোর জন্য ম্যালা ম্যালা ধন্যবাদ।
ডিবি অফিসার হাসানের পাঠানো তথ্যের উপর আর কোনো প্রশ্ন করেনি সাজু ভাই। কারণ প্রথম মেসেজ পাঠানোর পরে আবার আরেকটা মেসেজ দিয়েছিল হাসান। সেখানে লেখা ছিল ,
“ দিয়াবাড়ি নয় , প্রিয়াঙ্কা সিটি। প্রথমে লোকেশন সেরকম বোঝা যাচ্ছিল না। সম্পুর্ন এরিয়া দেখা যাচ্ছিল। ”
সাজু বুঝতে পারছিল ডাক্তারের বাসায় বড়সড় কোনো গন্ডগোল নিশ্চয়ই আছে। কিন্তু প্রখর রোদে আর কোথাও যাবার মতো শক্তি পাচ্ছিল না। বাইক নিয়ে সরাসরি বাসায় চলে গেল।
ভাবি তাকে দেখে অবাক হয়ে বললো ,
- তুমি বাসায় আসছো? আমি তো ভেবেছিলাম আসামি না ধরা পর্যন্ত আর বাসায় ফিরবে না।
ধপাস করে সোফায় বসে শরীর এলিয়ে দিয়ে চোখ বন্ধ করে বিড়বিড় করে সাজু বললো ,
- শরীরটা তেমন ভালো না ভাবি। বাহিরে রোদে বেশিক্ষন থাকতে পারি না। কি যে হলো!
- এখানে না বসে রুমে গিয়ে রেস্ট নাও৷ তার আগে খাবার দিচ্ছি, খাবার খেয়ে নাও।
হাসানের বউয়ের নাম তাসনীম। দীর্ঘ ১৩ বছরের বিবাহিত জীবনে এখনো তাদের কোনো সন্তান হয়নি। দুজনেই ভালো ডাক্তার দেখালো কিন্তু কারো কোনো সমস্যা ধরা পড়লো না। তবুও কেন যে আল্লাহ তাদের পরীক্ষা নিচ্ছেন কেউ জানে না। হাসানের সঙ্গে সাজুর রক্তের কোনো সম্পর্ক নেই। খুলনার খালিশপুরে থাকাকালীন সময়ে প্রথম পরিচয় হয়েছিল।
ঢাকার এই বাসায় সাজুর একটা রুম সবসময় বরাদ্দ করা থাকে। সাজু যেন হাসান বা তাসনীম এদেরই কারো আপন ভাই।
সাজু ফ্রেশ হয়ে অজু করে এসে জোহরের নামাজ শেষ করলো। তাসনীম ততক্ষণে খাবার সাজিয়ে দিয়েছে। খাবার খেয়ে রুমে গিয়ে বিছানায় শুয়ে লিয়াকতের কাছে কল দিল সাজু ভাই। কল রিসিভ হতেই সাজু বললো ,
- আমি বাসায় আসছি , কিছুক্ষণ ঘুমাবো। তুই কি প্রিয়াঙ্কা সিটিতে ডাক্তার ওবায়দুল মাসুদের বাসার সামনে কাউকে টহলে রাখতে পারবি?
- কেন পারবো না? এখনই তিন চারজন পাঠিয়ে দিচ্ছি।
- তিন চারজন নয় , একজনকে পাঠাবি। কিন্তু সে যে ওখানে নজরদারি করবে এটা যেন কেউ বুঝতে না পারে।
- গুপ্তচর নাকি?
- সেরকমই।
- আচ্ছা তাহলে বিষয়টা থানার কাউকে দিয়ে করাবো না। আমার কিছু লোকজন আছে ১৪ নাম্বার সেক্টরের ওখানে। ওদের দিয়ে করবো।
- ঠিক আছে, কিন্তু মনে রাখবি কাজটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
- চিন্তা করিস না৷ কাজ হয়ে যাবে।
- আরেকটা কাজ আছে।
- কি কাজ?
- সাকিব নামে একটা ছেলের এড্রেস দিচ্ছি। ওই ছেলের বিষয় খোঁজ খবর নিয়ে রাখ তো। ছেলেটা আসলাম ফরাজির বড় মেয়ে রাবেয়ার বয়ফ্রেন্ড ছিল।
- রাবেয়ার বয়ফ্রেন্ডের খোঁজ নিয়ে কি হবে?
- রাবেয়া বলছিল ওই সাকিবের সঙ্গে নাকি নুড়ির পুরনো কোনো শত্রুতা ছিল।
- সাংঘাতিক ব্যাপার তো।
- পারলে তুই নিজে খোঁজ নিবি। ছেলেটা সম্ভবত রাজনীতির সাথে জড়িত আছে। রাখি তাহলে।
মোবাইল রেখে সাজু চোখ বন্ধ করলো। প্রায় সঙ্গে সঙ্গে সে ঘুমিয়ে পড়লো৷ সাজুর সেই ঘুম ভাঙলো সন্ধ্যার খানিকটা আগে। শরীরে তাপমাত্রা বেড়েছে খানিকটা , পেট আর বুকের মধ্যেও ব্যথা হচ্ছিল। মোবাইল হাতে নিয়ে দেখলো সেখানে লিয়াকতের তেমন কোনো আপডেট নেই। তবে একটা মেসেজ সে পাঠিয়েছে।
“ বাড়ির সামনে আমার এক লোক একটা ট্রাক নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ইট বোঝাই করে সেখানে গিয়ে পরে ইঞ্জিন বন্ধ করে দাঁড়িয়ে আছে। সবার কাছে বলেছে ইঞ্জিন নষ্ট হয়েছে তাই সারাতে সময় লাগবে। সে ওখানেই আছে কিন্তু এখনো পর্যন্ত সেরকম সন্দেহের কিছু পায়নি। ”
ওয়াশরুমে সাজু গড়গড় করে বমি করলো। বুকের ব্যথা খানিকটা কমলো। হাতমুখ ধুয়ে বিছানায় এসে আবার ঘুমিয়ে গেল।
এবার তার ঘুম ভাঙলো রাত এগারোটার দিকে। আর সেটা এসআই লিয়াকতের কল পেয়ে।
বিছানা হাতড়ে মোবাইল হাতে নিয়ে ঘুম ঘুম চোখে কল রিসিভ করলো। ওপ্রান্ত থেকে লিয়াকত বেশ আতঙ্কিত হয়ে বললো ,
- সাজু, ডাক্তার সাহেব এখন হাসপাতালে। তাকে কে যেন তার বাসাতেই হত্যার চেষ্টা করছিল। এখনো বেঁচে আছে , ডাক্তাররা চেষ্টা করছে। এখন বর্তমানেে উত্তরা আধুনিক হাসপাতালে ভর্তি আছে।
ধড়ফড়িয়ে সাজু বিছানায় বসলো।
বললো ,
- কীভাবে কি হয়েছে ভালো করে বল তো?
- রাত নয়টার দিকে বাড়িতে একটা অপরিচিত ছেলে প্রবেশ করে। অনলাইনে খাবার ডেলিভারির নাম করে দারোয়ানকে বলে ভিতরে যায়।
- আচ্ছা তুই এখন কোথায়?
- আমি হাসপাতালে আছি।
- ঠিক আছে আমি আসতেছি।
কয়েক ঘন্টার ঘুমে শরীর খানিকটা ভালো। তবে দুর্বলতা যাচ্ছে না। তবুও ভাবিকে বলে বাইক নিয়ে বেরিয়ে গেল সাজু।
সাত নাম্বার সেক্টরে উত্তরা আধুনিক হাসপাতাল বা অনেকের কাছে বাংলাদেশ মেডিকেল নামেও পরিচিত। হাসপাতালে গিয়ে সবার আগে এসআই লিয়াকতের সঙ্গে দেখা করে। অদুরেই দাঁড়িয়ে আছে ডাক্তার সাহেবের ভাগ্নি। সাজু লিয়াকতের কাছেই প্রশ্ন করলো ,
- এখন কি অবস্থা?
- ডাক্তার বলছে ভয়ের আশঙ্কা নেই।
- চারিদিকে পুলিশ পাহারায় আছে তো? নাহলে শত্রু এখানেও আক্রমণ করতে পারে।
- কিছু হবে না, কড়া নিরাপত্তার ব্যবস্থা করেছি।
সাজু এবার ডাক্তার সাহেবের ভাগ্নির দিকে এগিয়ে গেল। মেয়েটার পাশের আরেকজন মাঝবয়সী মহিলা কাঁদছে। আনুমানিক মহিলাটা ডাক্তার সাহেবের স্ত্রী হতে পারে।
- আপনি যতটুকু জানেন বা দেখেছেন সবটুকু বলেন।
চোখে চোখ রেখে অভয় দিয়ে সাজু বললো।
- আমি আমার রুমের বেলকনিতে ছিলাম। মামা ড্রইং রুমে টিভি দেখছিলেন। হঠাৎ কলিং বেলের শব্দ পাই। যেহেতু মামা ড্রইং রুমে ছিল তাই আমি আর বেলকনি থেকে বের হইনি। পাঁচ মিনিট পর মামির চিৎকার শুনে দৌড়ে এলাম। এসে দেখি মামা অচেতন অবস্থায় দরজার সামনে পড়ে আছে। মামার মুখ থেকে রক্ত বের হচ্ছে। আর মামি তাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছে। মামার ডানপাশে দরজার কাছেই একটা পিৎজা পড়ে আছে।
পাশ থেকে লিয়াকত বললো ,
- যে ছেলেটা ডেলিভারি করতে এসেছে সেই ছেলে কাজটা করেছে সাজু। সম্ভবত পিৎজা হাতে নিয়ে টাকা দেবার জন্য মানিব্যাগের দিকে মনোযোগ দিয়েছে আর তখনই কিছু একটা করেছে।
- হতে পারে।
সম্মতি দিল সাজু ভাই।
- আরেকটা কথা ছিল সাজু ভাই।
আমতা-আমতা করে অনুমতি চাচ্ছে তাবাসসুম।
- জ্বি বলেন।
- আমার ডাকনামই অন্তরা। আজ সকালে আমিই আপনাকে কল করেছিলাম। আপনার সঙ্গে কথা বলার সময় সেখানে মামা চলে আসে। আমার হাত থেকে মামা-ই মোবাইল কেড়ে নেয়।
সাজু ও লিয়াকত দুজনেই অবাক হয়ে একে অপরের দিকে তাকিয়ে রইল। লিয়াকত বললো ,
- তাহলে সাজু যখন আপনার মামার বাসায় দ্বিতীয়বার গিয়ে জিজ্ঞেস করলো তখন সবকিছু গোপন করলেন কেন?
- নুড়ি নামের সেই মেয়েটার মিথ্যা ক্যান্সার রিপোর্ট সাজানো আর সবকিছু ঠিকঠাক ম্যানেজ করার জন্য মামা ওদের কাছ থেকে কয়েক লক্ষ টাকা নিয়েছে।
- সামান্য একটা কাজের জন্য এতগুলো টাকা?
সাজু বললো ,
- আমার সঙ্গে কথা বলার সময় আপনার কাছ থেকে যখন মোবাইল কেড়ে নেওয়া হয় তখন আপনি একটা শব্দ বলেছিলেন। “ কে আপনি ”? লোকটা যদি আপনার মামা হয় তাহলে আপনার তাকে চিনতে পারেন নাই কেন?
- পিছন থেকে মোবাইল নিয়েছিল তাই অস্ফুটে মুখ থেকে বেরিয়ে গেছিল। কিন্তু যতক্ষণে বুঝতে পারলাম ওটা আমার মামা ততক্ষণে তিনি মোবাইল বন্ধ করে দিয়েছে।
- তারপর কেন বলেন নাই? কেন মিথ্যা নাটক করে সাজুকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করলেন?
প্রশ্ন করলো লিয়াকত আলী।
- মামার কোনো সন্তান নেই , আমার মা-বাবা দু'জনেই আলাদা হয়েছে আমার ছোটবেলায়। তারা দুজনেই আলাদা আলাদা বিয়ে করে নতুন সংসার নিয়ে সুখে আছে। মামা আমার বিয়ে ঠিক করেছে সপ্তাহ খানিক আগে। কিন্তু আমি একটা ছেলেকে পছন্দ করি। মামা সেই ছেলেকে মেনে নিতে রাজি নয়।
লিয়াকত বিরক্ত হয়ে বললো৷
- এসব আমরা জেনে কি করবো?
সাজু লিয়াকতকে থামিয়ে দিয়ে অন্তরাকে বলার জন্য ইশারা করেন।
- ছাদে দাঁড়িয়ে মোবাইল কেড়ে নিয়ে মামা বলে , “তারমানে তুই সব জানিস তাই না? ওকে ফাইন, তোর সামনে দুটো পথ খোলা আছে। প্রথমত তুই তোর পছন্দের ছেলেকে বিয়ে করতে পারবি। তার বিনিময়ে তোকে ওই ডিটেকটিভের সামনে মিথ্যা অভিনয় করতে হবে। ”
- আর দ্বিতীয় পথ কি ছিল?
- বলেছিল , আমি যদি সবকিছু জানিয়ে দেই তাহলে ওই লোকগুলো মামাকে, আমাকে, সবার ক্ষতি করবে। সেজন্য আমি বাধ্য হয়ে তখন মামার সঙ্গে বাসায় এসে আপনি আসার পরে ওরকম মিথ্যা কথা বলেছি।
এসআই লিয়াকত তখন সাজুকে কথার মাঝখানে হাত ধরে টেনে এক সাইডে নিয়ে গেল।
সাজু বললো ,
- কি হয়েছে?
লিয়াকত তার মোবাইল বের করে হোয়াটসঅ্যাপ থেকে কয়েকটা ছবি দেখালো।। ছবিতে দেখা যাচ্ছে , একটা রেস্টুরেন্টে রাবেয়া ও আরেকটা ছেলে বসে আছে। ছবিগুলোর মধ্যে ১৭ সেকেন্ডের একটা ভিডিও আছে। দুজন কোনো বিষয় নিয়ে মনোযোগ দিয়ে কথা বলছে।
লিয়াকত বললো ,
- এটাই সেই সাকিব। তুই দুপুরের পরে সাকিবের খোঁজ খবর নিতে বলার জন্য আমি এর পিছনেও একজন স্পাই লাগিয়ে রেখেছিলাম। কিছুক্ষণ আগে সে ছবিগুলো পাঠিয়েছে।
সাজু বললো ,
- রাবেয়া আবার সাকিবের সঙ্গে কেন?
- এদের মধ্যেও কোনো ঝামেলা আছে। সবদিক শুধু ঝামেলা, কোই যাবো আমি?
লিয়াকতের কথা শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গে সাজুর মোবাইলে সাইমুনের কল এলো।
.
.
লাইক কমেন্ট করে নিজের হাজিরা দিয়ে যাবেন।
.
চলবে...

Comments

Popular posts from this blog

টু ফাইভ এইট জিরো -- ১

টু ফাইভ এইট জিরো -- ২

গুরুত্বপূর্ণ হোক সকল জেলা