টু ফাইভ এইট জিরো -- ১

বাড়িওয়ালা বললেন,

তুমি যার দিকে প্রতিদিন তাকিয়ে থাকো, সে আমার একমাত্র মেয়ে, তবে বিধবা। বিয়ের আটদিন পরে স্ট্রোক করে ওর স্বামী মারা গেছে। এখন চুপচাপ আর শুনশান নীরবতা হচ্ছে ওর প্রিয় খুব প্রিয়।
বুকের মধ্যে ধাক্কা লাগলো যেন। মেয়েটা চমৎকার সুন্দরী, রোজ সকালে তাকে ছাঁদে দেখি৷ আবার সন্ধ্যা বেলা থেকে গভীর রাত অব্দি ছাদের উপর পায়চারি করে। কখনো সাহস করে কথা বলতে যেতে পারিনি। অবশ্য আমি এ বাসায় ভাড়ায় উঠেছি মাত্র সপ্তাহ খানিক আগে। এ বাসায় আমি ভাড়া নেবার একটা বড় কারণ আছে। পেশাগত কারণেই এখানে আসা, কিন্তু কেন এসেছি সেটা এরা কেউ জানে না।
বললাম,
- আপনি তাকে আবার বিয়ে দেবার চেষ্টা করে দেখেননি? নাকি সবকিছু তার নিজের সিদ্ধান্তের ওপর ছেড়ে দিয়েছেন?
- তাইশা (আঙ্কেলের মেয়ে) একটা ছেলেকে পছন্দ করতো। তাইশা তাকেই বিয়ে করতে চেয়েছিল। কিন্তু আমার কাছে সেই ছেলেকে নিজের একমাত্র মেয়ের জন্য যোগ্য মনে হয়নি। তাই তড়িঘড়ি করে আমি অন্য যায়গা তাইশার বিয়ে ঠিক করি।
- আপনার তো আর দ্বিতীয় কোনো মেয়ে নেই তাই না আঙ্কেল?
- হ্যাঁ! তাইশা আমার একমাত্র মেয়ে। তাইশার বড় দুই ভাই স্পেনে থাকে। আমার মেয়েকে যতটা রাগি মনে করো, সে কিন্তু ততটা রাগি নয়। ওর মতো মিশুক মানুষ খুব কমই আছে জগতে।
- তাইশার সেই প্রেমিকার কোনো খোঁজ জানেন? মানে আপনার মেয়ের এরকম পরিস্থিতিতে সেই ছেলের সাপোর্ট দরকার ছিল। সাপোর্ট পেলে সে হয়তো এতটা ডিপ্রেশনে যেত না।
আঙ্কেলের মুখটা বিমর্ষ হয়ে গেলন। মেয়ের এক্স বয়ফ্রেন্ডের কথা জিজ্ঞেস করাতে কেমন যেন বিব্রত হয়ে গেলেন।
মুহুর্তের মধ্যে গম্ভীর হয়ে তিনি বললেন,
- আমার মেয়ে গতকাল রাতে তোমার কথা জিজ্ঞেস করলো তাই তোমাকে ডেকে আমার মেয়ের কথা জানালাম। তুমি তো জানো তোমার অফিসের ম্যানেজারের অনুরোধে তোমাকে আমি আমার বাসা ভাড়া দিয়েছি।
- জ্বি তা ঠিক আছে, কিন্তু আপনি হঠাৎ করে প্রসঙ্গ পরিবর্তন করে এসব কেন বলছেন?
- তোমার নামটা যেন কি?
- শাকিল আহমেদ রুদ্র, সবাই রুদ্র বলে ডাকে।
- শোন বাবা রুদ্র, পারিবারিক আর পাবলিক বলে দুটো বিষয় আছে। কিছু কিছু বিষয় আছে আর সেগুলো পাবলিকের কাছে বলা যায় না বা প্রকাশ করতে হয় না।
- ঠিক আছে, ব্যক্তিগত বিষয় জিজ্ঞেস করার জন্য আমি দুঃখিত।
- এবার তুমি আসতে পারো।
কিছু রহস্য নিয়ে বাড়িওয়ালার সামনে থেকে বের হয়ে এলাম। বাড়িটা তৈরি করার সময় ছাদের এক প্রান্তে দুটো রুম করা হয়েছে। তার মধ্যে একটা রুম স্টোর হিসেবে ব্যবহার করেন বাড়িওয়ালা। আর একটা রুম খালি, আমি সেখানেই থাকি। রুমে এসে অফিস ড্রেস চেঞ্জ করে জানালার পাশে বসে রইলাম। একটু পরেই মাগরিবের আজান দিবে। আজানের পরেই তাইশা ছাঁদে আসবে। আমি মনে মনে আজ তাইশার সঙ্গে কথা বলার প্রতিজ্ঞা করলাম। খাটে বসেই জানালা দিয়ে বাহিরে তাকিয়ে রইলাম।
মোবাইলে রিং বাজতেই ঘুম ভেঙ্গে গেল। অফিস থেকে এসে ক্লান্ত ছিলাম তাই জানালার পাশেই বিছানায় কখন ঘুমিয়ে গেছি বুঝতে পারিনি। মোবাইল হাতে নিয়ে দেখি চট্টগ্রাম থেকে আমার বন্ধু রাশেদ কল করেছে।
- হ্যাঁ বন্ধু বল।
- কিরে কতবার কল দিলাম, রিসিভ করিস না কেন জানতে পারি?
- ঘুমিয়ে ছিলাম।
- তুই নাকি গতকাল আমার সেই পুরনো হাসপাতালে গিয়ে আমার খোঁজ করেছিস? আচ্ছা রুদ্র, তুই কি এখনো সেই একরাতে দেখা হওয়া মেয়েটাকে খুঁজে বেড়াচ্ছিস?
- তোকে কে বললো?
- আমি নাহয় হাসপাতাল থেকে চলে এসেছি কিন্তু আমার কিছু সহকর্মী তো আছে। তাদের মধ্যেই একজন তোকে চিনতে পেরেছে।
কথা বলতে বলতে জানালার দিকে চোখ গেল। তাইশা ছাদে দাঁড়িয়ে আছে। আমি রাশেদকে বললাম,
- দোস্ত আমি তোকে একটু পরে কল দেবো।
- কেন এখন কি হয়েছে?
- আরে বুঝতেই তো পারছিস, ঘুম থেকে উঠেছি তাই ওয়াশরুমে যেতে হবে।
- আচ্ছা ঠিক আছে যা তাহলে।
মোবাইল কল কেটে দিয়ে দরজা খুলে বাহিরে বের হলাম। আস্তে আস্তে তাইশার কাছে গিয়ে একদম কাছাকাছি দাঁড়িয়ে রইলাম। কি বলে প্রথম কথা শুরু করবো সেটা মনে মনে সাজাচ্ছি।
আমাকে অবাক করে দিয়ে তাইশা বললো,
- সন্ধ্যা বেলা ঘুমের অভ্যাস ভালো না, শরীর অসুস্থ হয়ে যাবে। তারচেয়ে বরং অফিস থেকে ফিরে ছাঁদে বসে থাকবেন। শহর জুড়ে সন্ধ্যার আগমনে আস্তে আস্তে অন্ধকার হবার দৃশ্য দেখবেন।
আমি কোনো কথা খুঁজে না পেয়ে বললাম,
- আপনি কেমন আছেন?
- আমি তো ভেবেছিলাম আপনি শুধু জানালা দিয়ে উঁকি দেওয়া ছাড়া আর কিছু পারেন না। এখন তো দেখি মেয়েদের সঙ্গে কথাও বলতে পারেন।
- আসলে একটা কথা জানার খুব ইচ্ছে।
- কি কথা?
- সরাসরি বলবো নাকি ভূমিকা, প্রসঙ্গ তারপর মূল বক্তব্য।
- ভূমিকা আর প্রসঙ্গ অলরেডি শেষ হয়ে গেছে। এবার মূল বক্তব্য শুরু করতে পারেন।
- আপনার বাবার কাছে আপনার সম্পর্কে কিছু কিছু কাহিনী শুনলাম। সবকিছুর মধ্যে আমার শুধু আপনার এক্স বয়ফ্রেন্ডের কথা জানতে ইচ্ছে করছে।
- ওর কথা কেন? আর কি কি জানতে চান?
- মানে সে কোথায় আছে, আপনি তার সঙ্গে বিয়ে করবেন না বলে কীভাবে মিটমাট করেছেন। সে আপনাকে পাবে না জেনে কিরকম আচরণ করেছিল? আপনার হাসবেন্ড মারা যাবার পর সে কি যোগাযোগ করেছে?
তাইশা মুখ ঘুরিয়ে বললো,
- আজই আপনার সঙ্গে আমার প্রথম কথা শুরু। আর আজই আপনি এতকিছু জিজ্ঞেস করছেন?
- আপনার বাবার কাছে জিজ্ঞেস করলাম, তিনি অদ্ভুত আচরণ করেছেন। তাই আরো বেশি আগ্রহ দেখা দিচ্ছে। আর আমি একবার একটা বিষয় আগ্রহী হলে সেটা শেষ নাহলে কোনকিছু ঠিক মতো করতে পারি না।
- সে আমার বিয়ের আগেই মারা গেছে। আশা করি তার পরের প্রশ্ন গুলোর আর কোনো উত্তর দিতে হবে না।
প্রায় দুই মিনিটের মতো চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলাম। তারপর বললাম,
- কীভাবে মা!রা গেছে?
- এক্সি!ডেন্টে।
- এক্সি!ডেন্ট নাকি হ!ত্যা?
- মানে?
- না কিছু না।
- আপনার প্রশ্ন করা শেষ হয়েছে?
- জ্বি। আরেকটা কথা, তার নাম কি ছিল?
- নিয়াজ হাসান। এবার কি আমরা প্রসঙ্গ পাল্টে কথা বলতে পারি?
- জ্বি।
- বাবার কাছে শুনলাম আপনি এখনো বিয়ে করেননি। আপনি চাকরি, তারপর বাকি সবকিছু তো ঠিকঠাক আছে। তাহলে বিয়ে করতে আর কতো দেরি? নাকি কারো জন্য অপেক্ষা?
- বিয়ে না করেই তো বেশ ভালো আছি।
- কিন্তু এই-যে বাসা ভাড়া নিতে গিয়ে কতটা ঝামেলা পোহাতে হয়। এরচেয়ে তো বিয়ে করে পরিবার নিয়ে থাকা ভালো।
- আপনার স্বামী যেদিন মারা গেলেন সেদিন আপনি কোথায় ছিলেন? বাবার বাড়িতে নাকি শশুর বাড়িতে।
- আবার সেই প্রসঙ্গ?
- রাগ করলেন?
তাইশা তার মোবাইলের স্ক্রিনে তাকিয়ে বললো,
- আমার নাস্তা করার সময় হয়ে গেছে। প্রতিদিন এই সময়ে নাস্তা করে তারপর আবার ছাদে আসি। আপনার সঙ্গে পরে কথা হবে।
- ঠিক আছে।
তাইশা চলে গেল, বাবা মেয়ের দুটো ভিন্ন চরিত্র আবিষ্কার করলাম। তাইশার বাবা নিয়াজ হাসান এর কথা শুনে গম্ভীর হয়েছিল। আর তাইশা চলে গেল তার স্বামীর কথা শুনে। দুজনের এই গম্ভীর হবার রহস্যের সঙ্গে কারণ কি আলাদা নাকি একই বুঝতে পারছি না।
তাইশার সঙ্গে আর দেখা হলো না। কারণ কিছুক্ষণ পরেই বৃষ্টি নামলো। আমিও আর দাঁড়িয়ে না থেকে দ্রুত রুমের মধ্যে গিয়ে বসলাম। রাতে আমার শুকনা খাবার ছাড়া আর কিছু খাওয়া হয় না। তাই রাতের খাবার শেষ করে বিছানায় বসে বসে খোলা জানালা দিয়ে বাহিরে তাকিয়ে রইলাম৷ মাঝে মাঝে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে, ভেজা শহরের দিকে তাকিয়ে কিছু সময়ের জন্য নিজের দায়িত্ব যেন ভুলে গেলাম।
প্রায় ঘন্টা খানিক পরে বৃষ্টি কমলো। বৃষ্টি নামার একটু পরেই বিদ্যুৎ চলে গিয়েছে। আমি একটা মোমবাতি জ্বালিয়ে বসে রইলাম কিছুক্ষণ। রুমের মধ্যে তখন হালকা গরম লাগছিল। বৃষ্টির কারণে গরম কমার কথা কিন্তু তেমন কমলো না।
যেহেতু বৃষ্টি হয়েছে তাই বাহিরের বাতাস ছিল খুব ঠান্ডা। জানালার গ্লাস এক সাইডে সরিয়ে দিয়ে শুয়ে পড়লাম। ছোট্ট একটা রুম, জানালার পাশেই খাট। জানালা দিয়ে হালকা বাতাস প্রবেশ করছে রুমে। রাশেদের কাছে আর কল করা হলো না।
কখন ঘুমিয়েছি জানি না, কিন্তু শরীরের মধ্যে তীব্র জ্বালাপোড়া অনুভূতি হবার সঙ্গে সঙ্গে ঘুম ভেঙ্গে গেল। সম্পুর্ণ শরীর জ্বলে যাচ্ছিল, হঠাৎ করে বুঝতে পারলাম আমার পায়ে কোনো শক্তি পাচ্ছি না। মুখ দিয়ে শুধু বাঁচাও বাঁচাও শব্দ করলাম।
এমন সময় জানালার সামনে কারো ছায়ামূর্তি দেখতে পেলাম। কেউ একজন দাঁড়িয়ে আছে সেখানে। ছায়ামূর্তি বললো,
- কেমন লাগছে সাহেব? খুব কষ্ট তাই না?
কণ্ঠটা তাইশার, আমি অবাক হয়ে জানালার দিকে তাকিয়ে রইলাম। সমস্ত শরীর ব্যথায় অচেতন হবার অবস্থা। তাইশা আবার বললো,
- আমার এক্স বয়ফ্রেন্ড এখানে এই রুমেই ভাড়ায় থাকতো। আপনি এখন যেভাবে মারা যাচ্ছেন, ঠিক সেভাবেই তাকেও খু!ন করেছিলাম। মৃত্যুর পরে ওপাড়ে ভালো থাকবেন সাহেব। বিদায়।

Comments

Popular posts from this blog

টু ফাইভ এইট জিরো -- ২

গুরুত্বপূর্ণ হোক সকল জেলা