উনত্রিশ ফেব্রুয়ারি -- ৫

 সাজু ভাই বাসার সামনে এসে বাইক থামিয়ে দারোয়ানকে গেইট খুলতে বললো। দারোয়ান সামান্য অবাক হয়ে বললো ,

- আপনি না একটু আগে গেলেন?
- হ্যাঁ , কিন্তু আরেকটা জরুরি কাজ বাকি রয়ে গেছে তাই আবার এসেছি।
দারোয়ান কিছু না বলে গেইট খুলে দিল। যেহেতু খানিকক্ষণ আগেই এরা এসেছিল তাই ডাক্তারের কাছ থেকে অনুমতিরও দরকার মনে করলো না। সাজু গেইট দিয়ে প্রবেশ করে সরাসরি ডাক্তারের ফ্ল্যাটে চলে গেল।
কলিং বেল বাজতেই মেয়েটা এসে দরজা খুলে দিল৷ সাজুকে দেখে হাসতে হাসতে বললো ,
- আরে সাজু ভাই আপনি আবার এসেছেন? কিছু ফেলে গেছেন নাকি?
সাজু কিছুটা চিন্তার মধ্যে পড়ে গেল। কল দিয়ে মেয়েটা তার নাম বলেছিল অন্তরা। আর তখন তার সাথে শেষ মুহূর্তে অস্বাভাবিক কিছু শুনতে পেয়েছে। কিন্তু ডাক্তার সাহেবের ভাগ্নি এই মেয়ের মধ্যে তো সেরকম কিছু দেখছে না।
সাজু বললো ,
- আপনি কি একটু আগে আমাকে কল করেছেন?
সাজুর প্রশ্নে মেয়েটা যেন আকাশ থেকে পড়ছে। চোখ কপালে তুলে বললো ,
- আমি? কোই না তো, আপনার নাম্বার তো নাই আমার কাছে। তাছাড়া আপনি একটু আগেই এখান থেকে বের হয়েছেন। কল কেন দেবো?
সাজু যেন নিজেকে নিজে বিশ্বাস করতে পারছে না। মোবাইল হাতেই ছিল , কললিস্ট থেকে সেই নাম্বারে আবার কল দিল। নাম্বার বন্ধ।
সাজু ভাই নাম্বারটা মেয়েটার দিকে দেখিয়ে বললো ,
- এই নাম্বারটা চিনতে পারেন নাকি দেখেন তো।
মেয়েটা ভালো করে সেটা দেখলো। তারপর সাজুর দিকে তাকিয়ে রইল। বললো ,
- না সাজু ভাই , আমি তো চিনি না।
সাজু চুপচাপ কিছু ভাবতে লাগলো। সাজুর এমন নীরবতা দেখে মেয়েটা বললো ,
- কোনো সমস্যা হয়েছে সাজু ভাই?
দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে সাজু বললো ,
- নাহ তেমন কিছু নয় , আপনার নামটা জানতে পারি?
- অবশ্যই , আমার নাম তাহিয়া তাবাসসুম।
- ওহ্ আচ্ছা , ঠিক আছে তাবাসসুম আমি তাহলে আসি৷ পরে আবার কথা হবে।
বিদায় নিয়ে সাজু অনেকটা চিন্তিত হয়ে বাসা থেকে বের হয়ে গেল। রাস্তায় নেমে বাইকে বসে রাস্তায় চলতে চলতে শুধু ভাবছে কলটা কার ছিল?
বাইক চালিয়ে সাজু সরাসরি আজমপুরে চলে এলো। এসআই লিয়াকতকে কল দিতেই সে বের হয়ে এলো। দুজন মিলে রাস্তার পাশের একটা চায়ের দোকানের সামনে দাঁড়াল।
সবকিছু শুনে লিয়াকত বললো ,
- মানুষ বলে না অতি ভক্তি চোরের লক্ষণ। আমার তো মনে হয় সাইমুনের মধ্যে কোনো ঝামেলা আছে।
- থাকতেও পারে।
উদাস হয়ে উত্তর দিল সাজু।
- এদিকে শুধু শুধু ওই বাসার ছাদের চিলেকোঠার দু'জনকে ধরে নিয়ে এসেছি। আসার পর থেকে ননস্টপ কান্না করতেছে৷ ওসি সাহেব তো বিরক্ত হয়ে বলছে এদের তাড়াতাড়ি চালান করে দাও।
- তুই কোনো জিজ্ঞেসাবাদ করিস নাই?
- করেছি না আবার। কোনো জবাব নেই , কোনো কথা নেই। শুধু বলে, আমরা কিছু করি নাই। আমরা নির্দোষ।
- সাইমুন যে অফিসে চাকরি করে সেই অফিসের ঠিকানা আছে? একটু দেখা করতে চাচ্ছিলাম।
- হ্যাঁ আছে তো, সেই মেয়েটা নিজেই তো ঠিকানা দিয়ে গেল। কিন্তু ওই ডাক্তারের কি করবি? তাকে তো সন্দেহের তালিকায় রাখা দরকার।
- তোকে যে বলেছিলাম ওই বাসায় গিয়ে নুড়ির সব পুরনো টেস্ট রিপোর্ট কালেক্ট করতে। সেগুলো এনেছিস?
- ওদের বাসায় কোনো রিপোর্ট নেই। গতকাল রাতেই তো আমরা তেমন কিছু পেলাম না। আমার মনে হয় খুনি সেগুলো নিয়ে গেছে।
- তুই হাসপাতালে কথা বলে পোস্টমর্টেম রিপোর্ট যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আনার ব্যবস্থা করবি। তখন সবকিছু ওই রিপোর্টেই পাওয়া যাবে।
- একটা কথা বলি দোস্ত।
- বল।
- এই মামলাটা যদি আমি শেষ করতে পারি তাহলে ডিপার্টমেন্টে অনেক সুনাম অর্জন করতে পারবো। ক্যারিয়ার সামনের দিকে এগিয়ে নেবার বড় টার্নিং পয়েন্ট হবে।
- অবশ্যই সম্ভব হবে। চিন্তা করিস না, মনোযোগ দিয়ে কাজ কর। সব হবে ইন-শা-আল্লাহ।
লিয়াকতের সামনে দাঁড়িয়ে সাজু আরেকটা কাজ করে নিল। ডিবি অফিসার হাসানের কাছে কল দিয়ে কিছুক্ষণ আগে যে নাম্বার দিয়ে কল এসেছে সেই নাম্বারটা পাঠিয়েছে। প্রথমে কল করেছিল কিন্তু হাসান কল রিসিভ করেনি৷ একটা টেক্সট পাঠিয়েছে “ ব্যস্ত ”।
সাজু হোয়াটসঅ্যাপে নাম্বারটা পাঠিয়ে নিচে লিখে দিয়েছে ,
❝ নাম্বারটা এখন বন্ধ আছে। বন্ধ হবার আগে এই নাম্বারটার লোকেশন কোথায় ছিল সেটা জানাটা খুব জরুরি। ফ্রী হয়ে আপনার অফিস থেকে যদি কাজটা করে দেন তাহলে খুব ভালো হয়। ❞
যেহেতু কেইসটা এখন পুলিশের কাছে তাই হাসান সরাসরি এখানে জড়িত হতে চাইবে না। এর আগে অনেকবারই সাজু এভাবে টুকটাক তথ্যের জন্য হাসান ভাইয়ের সাহায্য নিয়েছে।
-----------
বাহির থেকে বিল্ডিংটা যেরকম দেখাচ্ছে আসলে ভিতরটা সম্পুর্ণ আলাদা। প্রতিটি জিনিসের দিকে নজর দিলে বোঝা যায় অনেক যত্ন করে সবকিছু সাজানো হয়েছে। রিসিপশনের মেয়েটা সাজুকে বসতে বলে তৃপ্তির কাছে কল দিল।
সাজু ভেবেছিল তাকে হয়তো পিওন ধরনের কেউ এসে নিয়ে যাবে। কিন্তু তৃপ্তি নিজেই রিসিপশনে চলে আসবে এতটা আশা করেনি।
- কেমন আছেন সাজু সাহেব?
- জ্বি আলহামদুলিল্লাহ , আপনাকে বিরক্ত করতে চলে এলাম। তবে বেশি সময় নষ্ট করবো না।
- কোনো সমস্যা নেই , প্লিজ আসুন।
তৃপ্তি নিজেই সাজুকে নিয়ে তার রুমে গেল। সাজু চারিদিকে তাকিয়ে আরেকবার অবাক হলো। মুখোমুখি বসে তৃপ্তি বললো ,
- কি খাবেন বলেন।
- কিছু খাবো না।
- আপনার ফেবারিট ঠান্ডা কফি নিন! আপনার সঙ্গে সঙ্গে আমিও নাহয় খেলাম।
- তা দিতে পারেন।
কফির অর্ডার দিয়ে তৃপ্তি টেলিফোনে কথা বলতে শুরু করে। কথার ধরেন বোঝা যাচ্ছে বিজনেস রিলেটেড কোনো বিষয় নিয়ে কথা হচ্ছে।
কথার মাঝে কফি এলো। কথা শেষ করে তৃপ্তি বললো ,
- স্যরি।
- সাইমুন সাহেবের সাথে আপনার কথা হয়েছে?
- হ্যাঁ , সকালে একবার কল দিয়ে স্যরি বলছিল। আর কিছুক্ষণ আগে আবার কল দিয়ে বললো আমি তার স্ত্রীর সঙ্গে রাতে কি কি বলেছি এসব।
- সাইমুনের বিষয় আপনাকে কিছু প্রশ্ন করবো। আশা করি সঠিক জবাব দিবেন।
- অবশ্যই, প্লিজ।
- আগেই ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি কারণ প্রশ্নগুলো একটু নেগেটিভ মনে হতে পারে।
- সমস্যা নেই আপনি বলুন।
- সাইমুনের সঙ্গে আপনার কোনো সম্পর্ক ছিল? মালিক ও এমপ্লয়ি এর বাইরেও কোনো সম্পর্ক ছিল কি-না সেটা জানতে চাচ্ছি। ধরুন বন্ধুত্ব।
- সেরকম কিছু ছিল না। বরং তার বিষয় আমার কাছে সবসময় একটা নেগেটিভ চিন্তা কাজ করতো। কারণ আমার বাবা একসময় তার সঙ্গে আমাকে বিয়ে দিতে চেয়েছিলেন।
- আপনারা এতো টাকাপয়সার মালিক কিন্তু তবুও আপনার বাবা ওনার মতো সামান্য কর্মচারীর সঙ্গে বিয়ে দিতে চাচ্ছিলেন। বিষয়টা ঠিক বুঝলাম না।
- বাবা কেন চেয়েছিলেন সেটা তিনিই বলতে পারবেন। অবশ্য এ নিয়ে বাবাকে আমি কখনো জিজ্ঞেস করিনি।
- সাইমুন কি জানতেন?
- প্রথমে জানতেন না , মাস দুয়েক আগে বাসায় একটা চায়ের নিমন্ত্রনে সাইমুনকে বাবা কথাটা বলেছিল।
- আপনি গতকাল রাতে বলেছিলেন যে সাইমুন আপনাদের একটা বড় প্রজেক্টের কাজ নিয়ে চট্টগ্রামে ছিল। সেখান থেকে নিশ্চয়ই অসমাপ্ত কাজ রেখে তাকে ফিরতে হয়েছে।
- হ্যাঁ , কাজটা সম্পুর্ণ ওনার মাধ্যমে করতে হতো। প্রায় তিনমাস ধরে এই প্রজেক্ট চলছিল। আর দুটো দিন পার হলেই শেষ হতো। কিন্তু সাইমুন সাহেব চলে আসাতে পুরো প্রজেক্ট লস গেল, আমাদের কোম্পানির প্রায় পঞ্চান্ন কোটি টাকা লোকসান হয়ে গেল।
- তাহলে তো অনেক টাকা। কিন্তু সাইমুনের জীবন থেকে যে ঝড়টা গেল তাতে তো তাকে দোষারোপ করা যায় না।
- হ্যাঁ , সবটাই ভাগ্যের ব্যাপার। ব্যবসা করতে এমন লাভ-লস থাকবেই। তবে ওনার অসুস্থ স্ত্রীকে এভাবে কেউ খুন করলো এটা কাম্য নয়। তাছাড়া ওনার স্ত্রীর ছোটবোন অকালে প্রাণ হারালো।
সাজুর ফোনটা বেজে উঠলো৷
এক্সকিউজ মি-বলে সাজু কলটা রিসিভ করে।
- আসসালামু আলাইকুম।
- ওয়া আলাইকুমুস সালাম। সাজু সাহেব, আমি রাবেয়া। গতকাল যে বাসায় খুন হয়েছে সেই বাসার মালিকের বড় মেয়ে। মনে হয় চিনতে পেরেছেন।
- হ্যাঁ চিনতে পেরেছি।
- আমি আপনার সঙ্গে একটু দেখা করতে চাই। এখনই হলে ভালো হয়।
- কোন যায়গা আসবো বলেন।
- দিয়াবাড়ি প্রথম স্টেশন থেকে খানিকটা সামনে গিয়ে বামদিকে কিছুটা যাবার পরে একটা বড় রেস্টুরেন্ট আছে। আমি সেখানেই আছি।
- আপনি থাকুন, আমি আসছি।
তৃপ্তির কাছে বিদায় নিয়ে সাজু বাইক নিয়ে আবার বেরিয়ে গেল। লিয়াকতের কাছে কল দিয়ে বলে দিল সে কোথায় যাচ্ছে। সম্ভবত সাজু ভাই রাবেয়া নামের এই মেয়েটাকেও সন্দেহের মধ্যে রেখেছে।
-----------
সাজু ভেবেছিল ডাক্তারের বাসা থেকে বের হবার পরে যে কলটা এসেছিল সেরকম কোনো হয়রানির কল হতে পারে। যেহেতু একবার মেসেজ এসেছে , একবার কল এসেছে , আবার এখন আরেকটা কল এসেছে তাই এগুলো খুনির চক্রান্ত হিসেবেই বড় করে দেখছে সাজু ভাই।
কিন্তু রাবেয়া সত্যি সত্যি এসেছে। সে এখন সাজুর সামনে বসে আছে। সাজু ভাই বললো ,
- আপনি সম্ভবত কিছু বলতে ডেকেছেন।
- হ্যাঁ , কথাগুলো গতকালই আপনাকে বলা উচিত ছিল। কিন্তু ব্যক্তিগত কিছু সমস্যার কারণে তখন মা-বাবার সামনে কিছু বলতে পারিনি।
- ঠিক আছে বলুন কি বলতে চান।
- সাইমুন ভাইয়ার স্ত্রী আর আমার এক্স বয়ফ্রেন্ড একসঙ্গে একই ইউনিভার্সিটিতে পড়াশোনা করতো। সাকিবের বেশ কিছু বিষয় নিয়ে নুড়ি ভাবির সঙ্গে ওর ঝামেলা ছিল। সাকিব নুড়ি ভাবিকে খুন করার পরিকল্পনা করেছিল।
সাজু ধরেই নিল রাবেয়ার বয়ফ্রেন্ডের নাম সাকিব।
সে বললো ,
- পরিকল্পনার কথা আপনি জানেন কীভাবে?
- কারণ পরিকল্পনাটা সে আমার সঙ্গেই করেছিল। কিন্তু আমি ওর এমন প্রস্তাবে রাজি হইনি বলে আমাদের ব্রেকআপ হয়েছে।
- আপনি এটা গতকাল বলেন নাই কেন?
বিরক্ত হয়ে প্রশ্ন করলো সাজু ভাই।
- সাজু ভাই, সেখানে আমার মা-বাবা সবাই ছিল। তাছাড়া পুলিশের লোক ছিল অনেক। সবার সামনে আমি এগুলো কীভাবে বলতাম বলেন। আর এইসব ঘটনা আরো চার মাস আগের।
সাজু কিছু বলতে যাবে তখনই সাজুর হোয়াটসঅ্যাপে হাসানের রিপ্লাই আসে।
“ বন্ধ হবার আগে সেই নাম্বারটা উত্তরার দিয়াবাড়ি এলাকায় ছিল। ”
মেসেজ পড়ে সাজু রাবেয়ার দিকে তাকালো। বললো ,
- আপনি এখানে মানে দিয়াবাড়ি কখন এসেছেন?
- আমি সকালেই এসেছি। এই রেস্টুরেন্টের ক্যাশ কাউন্টারে আমিই বসি।
বিড়বিড় করে সাজু কিছু একটা বলতে লাগলো।
কি বললো ঠিক বোঝা গেল না।
.
.
.
চলবে...

Comments

Popular posts from this blog

টু ফাইভ এইট জিরো -- ১

টু ফাইভ এইট জিরো -- ২

গুরুত্বপূর্ণ হোক সকল জেলা